কক্সবাজার, শনিবার, ১৮ জানুয়ারী ২০২৫

টেকনাফ-উখিয়ার পাহাড়ে অপহরণের শিকার ২ শতাধিক, মুক্তিপণ আদায় আড়াই কোটি

কক্সবাজারের সীমান্ত উপজেলা টেকনাফ ও উখিয়ার পাহাড়গুলো ‘অপহরণ বাণিজ্য’র নিরাপদ আস্তানায় পরিণত হয়েছে। শুষ্ক মৌসুম শুরুর পর ‘মহামারি আকারে’ দেখা দিয়েছে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়। পাহাড়ের পাদদেশের ফসলী জমি কিংবা পাহাড়ে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিক বা খেলারত শিশু এবং মসজিদে যাবার সময়ও অপহরণের শিকার হচ্ছেন স্থানীয় ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সমবয়সী পুরুষ।

দাবি মতো মুক্তিপণ দিতে না পারলে সাগর পথে মালয়েশিয়া পাচার ভিকটিম হিসেবে পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে অপহৃতদের। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আইনশৃঙ্খলার নাজুক পরিস্থিতিতে একের পর এক অপহরণের ঘটনা ঘটেই চলছে। ক্রমে এ ঘটনা বাড়লেও স্থায়ী কোন সমাধান মিলছে না।

উপর্যুক্ত ভয়ঙ্কর সব পদ্ধতি অবলম্বনে মুক্তিপণ আদায় করছে ‘অপহরণ সন্ত্রাসীরা।’ সর্বশেষ উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঘরের কাছে খেলারত মুহাম্মদ আরাকান (৭) নামে এক শিশুকে অপহরণের পর গলা পর্যন্ত মাটিতে পুতে সেই অবস্থায় করা ভিডিওতে বাবার কাছে টাকা চাই ভীত শিশু আরাকান। অপহরণ চক্রের দাবি করা ৭ লাখ টাকা থেকে ২ লাখ ১০ হাজার টাকা বিনিময় করলে অপহরণের এক সপ্তাহ পর ১৫ জানুয়ারি সকালে জীবিত ঘরে ফিরে শিশুটি। গত ৮ জানুয়ারি দুপুরে দিকে খেলার সময় তাকে অপহরণ করা হয়েছিল।

আরাকানের বাবা উখিয়ার থাইংখালি ক্যাম্প-১৯’র ব্লক-সি-১৫ এর আব্দুর রহমান জানান, ৮ জানুয়ারি (বুধবার) দুপুরের পর ঘরের বাইরে আরাকান খেলছিলো। হঠাৎ তিনজন লোক নাস্তা দেওয়ার লোভ দেখিয়ে কৌশলে সিএনজিতে তোলে তাকে অপহরণ করে । রাতে ছেলেকে পাগলের মত সব জায়গায় খুঁজেছি। পরে অপহরণ চক্র কল করে ছেলেকে পেতে ৭ লাখ টাকা দাবি করে। তারা পাষাণের মতো আমার শিশুসন্তানকে মাটিতে গলা পর্যন্ত পুঁতে ভিডিও করে তা আমাদের কাছে পাঠায়। সন্তানের সমূহ বিপদ দেখে মায়ের নাক ফুল বিক্রি ও বিভিন্নজনের থেকে ধারদেনায় দু’লাখ ১০ হাজার টাকা তাদের দেখানো মতো স্থানে পাঠানো হয়। টাকা পেয়ে ছেলেকে হাত-পা বেঁধে কুতুপালং বাজারের পাশে ফেলে যায়। কিছু লোক ছেলেকে পেয়ে হেফাজতে রেখে ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়ার পর আমরা খবর পেয়ে বুধবার (১৫ জানুয়ারি) সকালে তাকে নিয়ে আসি। তাকে পাওয়ার পর অপহরণকারীদের নিষ্ঠুরতা দেখাতে আরাকানকে গর্তে মাটি চাপা দেওয়ার ভিডিওটি ফেসবুকে ছড়িয়ে দিই। যা দেশ-বিদেশে তোলপাড় তুলেছে। মানুষ অপহরণকারীদের প্রতি নিন্দা জানিয়ে আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছেন।

অপরদিকে, সোমবার (১৩ জানুয়ারি) প্রতিদিনের মতো মসজিদে ফজরের নামাজে যাবার পথে অপহরণের শিকার হন টেকনাফের হোয়াইক্যংয়ের মিনাবাজার ঘোনাপাড়ার বাসিন্দা শাকের আহমদ (৬০)। নামাজ শেষ হলেও বাড়ি না ফেরায় স্বজনরা সম্ভাব্য বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করেও তার সন্ধান পায়নি। তবে, রাতে নিখোঁজের স্ত্রীর নম্বরে অজ্ঞাত ব্যক্তি ফোন করে অপহরণের কথা জানিয়ে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। বিষয়টি পুলিশকে জানানো হলে ৩২ ঘণ্টার মাথায় ১৪ জানুয়ারি বেলা আড়াইটার দিকে হোয়াইক্যংয়ের খারাংখালীর কম্বনিয়াপাড়া পাহাড়ি এলাকায় অপহৃতকে ছেড়ে দেওয়া হয় বলে নিশ্চিত করেন ভুক্তভোগীর ছেলে আব্দুল্লাহ। তবে, এ জন্য মুক্তিপণ দেয়া হয়েছে কি না তা বলতে রাজি হননি তিনি। উদ্ধারের পর বাবাকে বিধ্বস্ত পাওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, মুক্তিপণ পেতে অপহরণকারীরা তাকে শারীরিক নির্যাতন চালিয়েছে।

গত ৫ ডিসেম্বর টেকনাফ ঘুরতে এসে টমটম চালকের সহায়তায় অপহরণের শিকার হন রাঙ্গামাটির বাসিন্দা উলাচি মারমা। আবাসিক হোটেলে নিতে বলার পর রওয়ানা দিয়ে পথে আরও তিন তরুণকে গাড়িতে তুলে তার সবকিছু ছিনিয়ে নিয়ে কয়েক যুবকের হাতে তুলে দেওয়া হয় তাকে। সেই যুবকরা বড় অঙ্কের টাকা দাবি করে পেতে ব্যর্থ হয়ে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে, মুক্তিপণ হিসেবে মালয়েশিয়া পাচার করতে এক বাড়িতে জড়ো করে। সেখান থেকে অন্য আরও ২৮জনের সঙ্গে ১৪ ডিসেম্বর রাতে পুলিশ তাকে সাইফুল নামে এক ব্যক্তির বাড়ি থেকে উদ্ধার করে।

সম্প্রতি একদিনের ব্যবধানে দুই সিএনজির চালকসহ আরও ৯ জন অপহরণের শিকার হন। এর আগে টেকনাফ বন বিভাগের পাহাড়ে কাজ করতে গিয়ে রোহিঙ্গা ও স্থানীয়সহ ১৯ জন শ্রমিককে অপহরণ করা হয়। তিনদিনে ২৮ জন অপহরণ হলে পুলিশ, র‌্যাব ও এপিবিএন যৌথ অভিযান চালায়। কিন্তু দুর্গম এলাকা হওয়ায় কাউকে শৃঙ্খলা বাহিনী উদ্ধার করতে পারেনি। পরে সবাই কমবেশি মুক্তিপণ দিয়ে ফেরত আসে। তবে, শৃঙ্খলাবাহিনী দাবি করে তাদের অভিযানে এদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

এসব ঘটনার পর, সাধারণ রোহিঙ্গা ও স্থানীয়রা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। কৃষক এবং বিভিন্ন পেশার লোকজন কাজে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। ভয়ে, রাতে ক্যাম্পে বাড়িতে থাকেন না রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝিরাও। অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করায় সন্ত্রাসীদের আটক করতে হিমশিম খাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিয়ানমারের কিছু সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে স্থানীয় কিছু ডাকাত চক্র মিলে এসব অপহরণ বাণিজ্য করছে। ডজনাধিক গ্রুপে শতাধিক রোহিঙ্গা ও স্থানীয় ডাকাত মিলে ঘটাচ্ছে এসব অপহরণ। তাদের হাতে রয়েছে ভারী অস্ত্রও। এদের সঙ্গে রয়েছে মানব পাচারকারীদের যোগসূত্রও। তারা বিদেশি পিস্তল, ইয়াবার হাতবদল ঘটাচ্ছে। ব্যবহার করছে বিশ্বের উন্নত প্রযুক্তি। এভাবে তারা হত্যাকাণ্ড, অপহরণ, ধর্ষণ, মানবপাচার ও চোরাচালানসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যকলাপে পাহাড়কে ‘অপরাধের স্বর্গরাজ্যে’ পরিণত করেছে।

স্থানীয়দের মতে, টেকনাফের বাহারছড়া, হ্নীলা, হোয়াইক্যং ও টেকনাফ সদর ইউনিয়ন, উখিয়ার থাইংখালী, বালুখালী, কুতুপালং, লম্বাশিয়াসহ প্রায় ক্যাম্প পাহাড় সমেত। দুর্গম পাহাড়ে আস্তানা গড়েছে ডজনাকি স্থানীয় ও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। শুষ্ক মৌসুম শুরুর পর হতে তারা শিশু, ছেলে-মেয়ে, শিক্ষার্থী, রিকশাচালক, মাছ ব্যবসায়ী, শ্রমিক, সাধারণ মানুষ কাউকেই বাদ দিচ্ছেন না। ফলে সবাই আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। অনেকে সন্ধ্যার পর সন্তানদের ঘরের বাইরে যেতে দেন না। অনেকে সন্তানদের বিশেষ পাহারায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠান। অপহরণের ঘটনায় থানায় জিডি ও অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার মিলে না- উল্টো হুমকি মিলে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক জনপ্রতিনিধি বলেন, অপহরণ দলের সদস্যরা দিনে ছদ্মবেশে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে কাকে অপহরণ করলে বেশি টাকা পাওয়া যাবে সেটা জানার চেষ্টা করে। পরে সেভাবে প্লান করে অপহরণের ঘটনা ঘটায়।

বাহারছড়া ইউনিয়নের কয়েক সদস্য বলেন, শুষ্ক মৌসুম শুরুর পর অপহরণ জ্যামিতিক হারে বেড়েছে। ভয়ে এলাকার লোকজন সন্ধ্যার পর ঘর থেকে বের হন না। গত মাস-চারেকে এলাকায় অর্ধশতাধিক অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই মুক্তিপণ দিয়ে ফিরেছেন। গত বছরের তুলনায় এ বছর অপহরণের ঘটনা বেশি। যদিও পুলিশের খাতায় কমই উঠছে।

হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কক্সবাজার জেলা জামায়াতের আমির নূর আহমদ আনোয়ারী বলেন, হোয়াইক্যংয়ের কম্বনিয়াপাড়া মহেশখালিয়াপাড়া, কাঞ্জরপাড়া, খারাংখালী, সাতঘরিয়াপাড়া, রইক্ষ্যয় এলাকার প্রায় ৫ শতাধিক পরিবার অপহরণ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। অতীতে এসব গ্রাম হতে অপহরণের পর চারজন হত্যা শিকারও হয়েছিল।

কক্সবাজার জেলা পুলিশ ও ভুক্তভোগীদের দেয়া তথ্য বলছে, টেকনাফের বাহারছড়া, শামলাপুর, জাহাজপুরা, হ্নীলা, লেদা, মুছনি, রইক্ষং, জাদিমুড়া, হোয়াইক্যং, বালুখালী, থাইংখালী, কুতুপালংসহ আশপাশের এলাকায় প্রায় অপহরণের ঘটনা ঘটছে। গত বছর দেড়েক সময়ে টেকনাফ-উখিয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় দু’শতাধিকজন অপহরণের শিকার হয়েছে। তাদের মাঝে অর্ধেক রোহিঙ্গা আর অর্ধেক স্থানীয় বাসিন্দা।

টেকনাফ থানার তথ্যমতে, ২০২৪ সালে অপহরণের মামলা হয়েছে ২০টি- এসব মামলায় উদ্ধার ৫৭ জন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ৪২টি অপহরণ মামলায় ৮১ ভিকটিম উদ্ধার। আসামির সংখ্যা প্রায় ৭০। এ গ্রেপ্তার হন ২০ জন। মানবপাচার আইনের সাতটি মামলায় ১৬৮ ভিকটিম উদ্ধার এবং ১৬ আসামি আটক হন।

টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন বলেন, টাকার লোভে একাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বাহিনী অপহরণ বাণিজ্যে নেমেছে। স্থানীয় অপরাধীদের সহায়তায় তারা এসব করছে। অপহরণ করে মুক্তিপণ না পেলে জোরপূর্বক মালয়েশিয়া পাচার চক্রের কাছে বিক্রি করে দেয় অপহরণ চক্র। ইতোমধ্যে অনেককে আটক ও ভিকটিম উদ্ধারে সক্ষম হয়েছি। বাকিদের ধরতে অভিযান চলমান।

কক্সবাজারের জেলা পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রহমত উল্লাহ বলেন, অপহরণের পর দুর্গম পাহাড়েই ঢুকে পড়ে অপহরণকারীরা। পুলিশের সেখানে একক অভিযান চালানোর মতো সরঞ্জাম নেই। তাই আমরা যৌথ অভিযান চালাতে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েছি। আশা করছি খুব দ্রুতই আমরা একটি সফল চিরুনি অভিযান চালাতে পারব। তবে, রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের বাইরে চলাচলের সুযোগ বন্ধ না হলে অপহরণের ঘটনা রোধ অনেকাংশে অসম্ভব। সেটি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নকে নিশ্চিত করতে হবে।

কক্সবাজার র‌্যাব-১৫-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন জানান, দুর্গম পাহাড়ে বাড়ানো হয়েছে র‌্যাবের গোয়েন্দা নজরদারি। বেশ কয়েকটি সফল অভিযানে অনেককে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। সর্বশেষ ৩১ ডিসেম্বর দীর্ঘ অভিযানে বনে অপহৃত ১৮জনকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়। অপরাধীদের বিষদাঁত ভেঙ্গে দেয়ার প্রচেষ্টা চলছে।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বলেন, পাহাড়ে অপহরণ এবং মানবপাচার বন্ধে প্রশাসনের সব সেক্টর যৌথভাবে কাজ করার উদ্যোগ চলছে। পাহাড় বেষ্টিত বিভিন্ন এলাকায় সিসিটিভি ক্যামেরা ও পুলিশের চৌকি স্থাপনের কথাও হয়েছে।

পাঠকের মতামত: